বাংলাদেশ ছেড়ে বহু মানুষ আশ্রয় নিল ভারতে। তাবুর নীচে দিন কাটিয়ে একে একে নতুন কলোনি বানিয়ে তাদের পুনর্বসনের ব্যবস্থা হল। আমার পরিবারও এই বৃহৎ পরিবারের ই অংশ। মজার বিষয় হলো এখানে বাংলা ভাষা যে কতরকমের হয়, তার নজির মিলল। একই শব্দ কত রকম ভাবে আমাদের পাড়ায় বলা হতো তা দু একটা উদাহরণ দিই, যেমন কেউ ‘দেখা’কে দ্যাহ, দেখতাছ, দেখছ, দেখতাম পারতাছো না, ইত্যাদি নানান ভাবে বলত। সরকার থেকে পুনর বসতি দেওয়া হইয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতেরর বিভিন্ন স্থানে এবং এই অঞ্চলটাকে কলোনি নাম দেয়া হয়েছিল। যখন সরকার থেকে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল তখন উঁচু-নিচু জাতির ভেদাভেদ করা হয়নি। ধরুন যাদের আমরা নাপিত বলি, ধোপা বলি, নমঃশূদ্র বলি তারাও যেমন ছিলেন, আবার বৈদ্য, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ সর্বস্তরের লোক ছিলেন। বিভিন্ন জেলা যেমন বরিশাল, ময়মনসিং, খুলন, পাবনা, সিলেট বিভিন্ন জায়গার লোক একসাথে একই পাড়ায় থাকতেন। তাতে সুবিধে হয়েছে এই যে, কোন অনুষ্ঠানে আমাদের ধোপা ,নাপিত লাগে তার জন্য বাইরে যেতে হতো না আবার অসুবিধাও ছিল। যারা তখন যাতে নিচু ছিলেন তারা অতটা লেখাপড়া জানতেন না বলে সমাজে অনেকটা পিছিয়ে ছিলেন আর যারা উচ্চবর্ণের লোক ছিল তাদের মধ্যে পড়াশোনাটা ছিল বলে, তারা ভালো চাকরি পেলেন। এদের মধ্যে একটা আলাদা সংস্কৃতি আমরা দেখতে পেতাম। এঁরা নিচু বর্নের লোকেদের সঙ্গে ঠিক খোলামেলা মিশতে পারতেন না। ফলে কেউ কেউ একটু তফাতে থাকতেন। এটার কিন্তু একটা কুফল ছিল। আমি ছোট থেকে দেখেছি, মানুষ একটু একটু করে পরিশ্রম করে সংসার দাঁড় করাচ্ছেন, কারণ তাঁরা ছিন্নমূল হয়ে এসেছিলেন। তাদের নিজস্ব ঘর-বাড়ি, জমি-জমা সব ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে তারা কেউ মুটেগিরি করেছেন, কেউ জোগাড়ের কাজ করেছেন, কেউ পরিচারকের কাজ করেছেন। বাড়ির মহিলা যারা এর আগে কখনো বাড়ির বাইরে বেরোয়নি, তারা অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে শুরু করেন। এইভাবে পরিশ্রম করে তারা সংসার প্রতিপালন করতেঙ। ছোটোরা লেখাপড়া শিখতে শুরু করে। এমত অবস্থায় দেখলাম অলিখিত একটা দেয়াল তোলা হয়েছে। যেমন ময়মনসিংহ বরিশালকে দেখতে পারতেন না বা যাদের পদবী সেন, বসুরায়, ধর বা চক্রবর্তী তারা কিন্তু আর সকলের থেকে আলাদা থাকতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে ছোটোরাও যুবক হতে শুরু করেছে। পাশাপাশি থাকা ছেলে মেয়েদের মধ্যে মন দেয়া নেয়া চলছে; এতে যেটা হল, যারা কায়স্থ তাদের ছেলে হয়তো নমঃশূদ্রের মেয়ের সঙ্গে মন বিনিময় করেছে। বড়রা সেটা মানতে পারছেন না, তখন দেখা গেল দুই জেলার লোকের মধ্যে বিরোধ সেটা মারামারির পর্যায়ে চলে গেল। আবার যারা বৈদ্য ছিলেন এবং লেখাপড়ায় অনেকটা এগিয়ে থাকার দরুন কথায় দু চারটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন। ইংরেজি ভাষা বুঝতে না পারার জন্য অনেকে তাদের ভুল বুঝতে শুরু করলেন এবং সেখানে একটা বড় সমস্যা তৈরি হল। যার কারণে একটা পরিবারকে পাড়া থেকে তুলেও দেয়া হয়।
যখন চীনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ লেগেছিল তখন আমি অনেক ছোট। যুদ্ধটা কি বুঝতাম না কিন্তু সন্ধ্যে হলেই দেখতাম পুরো পাড়ার সব আলো নিভিয়ে দেয়া হতো। আমাদের সামনের বাড়িতে যে পরিবার থাকত, তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলোনা। আর্থিক অনটনের দরুন, তারা ঘরের টিনের ছাউনিটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় সন্ধ্যেবেলা যখন সকলে ঘর অন্ধকার করে, জানলা দরজা দিয়ে রাখত, তখন ছাত না থাকায় ওই বাড়িতে কুপি জ্বালালে, তা চারিদিক থেকে দেখা যেত। কাজেই, সবাই তাদের এই বলে খুব বকাবকি করত যে, এই আলোটা দেখলে উপর থেকে প্লেন এসে বোম ফেলে যাবে, তাতে পুরো পাড়ার লোক মারা যাবে।
আমার কাকামশাই বিয়েতে একটা রেডিও পেয়েছিল। তিনি অরুণাচল যাকে তৎকালীন নেফা বলা হত, সেখানে চাকরি করতেন, তাই রেডিওটা সেখানে নিয়ে জাননি। যুদ্ধকালীন সন্ধ্যেবেলা সেই রেডিও ঘিরে পাড়ার যত বয়স্ক লোক ছিলেন, সবাই খবর শুনতেন। তখন সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে, সবাই সবার পাশে থেকেই ওই সময়টা পার করেছি।
মানুষ মানুষের সাথে যেমন যুদ্ধ করেছে, তেমনি পাশাপাশি হাত ধরে সমাজও গড়েছে। আজও বহুদেশ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঘর হারাচ্ছে। দেশ থেকে দেশান্তরে যাচ্ছে একটু নিরাপত্তার আশায়। বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে থাকার আশায়, পরিবারের ছোটদের স্থায়ী ভবিষ্যতের আশায়।
প্রার্থনা করি তারা সবাই নিজের নিশ্চন্ত ঠিকানা খুঁজে পাক। পৃথিবীতে শান্তি আসুক।
কলমে - মীনা দাস
লোকসংগীতশীল্পি (দীর্ঘ ৩০ বছর নিজস্ব লোকসংগীতের দল পরিচালনা করছেন)। একাধারে নিজ স্বাধীন ব্যবসার সাথে NGO পরিচালনা করে চলেছেন।
Mina is a folk singer. She's a successful business owner.
Committed to her NGO for social change.
All fact are original in my eyes.
From,
Nc